Monday, August 11, 2008

দলছুট


আমাদের মেয়েবেলায় কখনো এমন হয়নি যে টাকার অভাবে বই কিনতে পারিনি বা স্কুলের মাইনে দিতে পারিনি। তাই এর পরবর্তী ধাপগুলো সম্বন্ধে আরোই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। শহর কলকাতার স্কুলে পড়াশোনা করে এবং মোটামোটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে কোনোদিন ভাবিনি, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে/মফঃস্বলে এমনকি বহু শহরতলি এলাকাতেও অনেক পরিবারে অনেক ছেলে-মেয়ে শুধুমাত্র অর্থের সংস্থান করতে পারে না বলে মাঝপথে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

বছর বছর অনেক কৃতি ছেলে-মেয়ে বিদেশে পারি দেয় উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে। একদল পড়াশোনা শেষে নিজের মনের মতো বৃত্তি যোগার করে নিয়ে খুশী হয়। আগে যেমন শুনতাম, এখন দিনকাল অনেক পাল্টেছে, এখন এদেশে চাকুরীর বাজারটা তেমন মন্দার আর নয়। বহুজাতিক সংস্থার দৌলতে দেশের অর্থনীতির বাজারে জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মের জন্য চাকুরির সুয়োগ বেড়েছে। তাই এককালে যেমন ছিল ক্লাসের প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় স্থানপ্রাপকরাই জীবনে খুব সফল, উচ্চপদে কাজ করছে-চিত্রটা আর তা নয়। এখন মাঝারি তো বটেই এমনকি স্কুলে সবচেয়ে পেছনের দিকের ছেলেটাও ভালো চাকুরী পায়। সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে দেশের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে গত দুইদশকে। এ বড় ভালো লক্ষণ আমাদের দেশের জন্যে।

আমার এই লেখাটা যদিও ‘দলছুট’দের নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় ছোট থেকে পড়াশোনা করেছি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি স্কুলে এক বছর চাকুরীর সুবাদে এখানে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখতে চাই। আমি যে স্কুলে চাকুরী করতাম সেটি হাওড়া স্টেশন থেকে মিনিট দশ-পনেরো দূরে সালকিয়া বলে একটি অঞ্চলে। সাধারণ স্কুল, যারা স্কুলে পড়তে আসে তারা বেশির ভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত/ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তা বলে খুঁজলে কাউকেই স্বচ্ছল পরিবারের পাওয়া যাবে না, তাও নয়। এরা ইংরাজীতে কাঁচা। ক্লাস ফাইভের ইংরাজী ক্লাস নিতে গিয়ে দেখেছি গোটা ক্লাসে দু-তিনজন ছাড়া কেউ শুদ্ধ বাক্য লিখতে পারে না। অনেককেই আবার ABCD থেকে শুরু করতে হচ্ছে। মাতৃভাষায়-ও যে খুব দখল আছে, তা নয়। সবমিলয়ে 60+60+60=180 জন মেয়ে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষা যখন তারা দিতে বসে সংখ্যাটা দাঁড়ায় 90-100 জন! কোথায় যায় বাকী 80 জন? আমি এই প্রশ্নটা একবার শুরুরদিকে করেছিলাম এক সিনিয়ার সহশিক্ষিকাকে। তিনি বলেছিলেন ‘থাকতে থাকতে সবই বুঝে যাবি।’ ঐ একবছরে কিছুটা বুঝেছিলাম--অনেকটাই বুঝিনি!!

খুব ভালো করে চিত্রটা পরিস্কার হল বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট তৈরির সময়টাতে। ক্লাস সেভেন অবধি তিনটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েও সেই ছাত্রী নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হবার ছাড়পত্র পেত! ইংরাজী অঙ্ক বিজ্ঞানে পাশ না করেও দিব্যি ক্লাসে উঠে যাওয়া যেত! ক্লাস-টীচার কোনো ছাত্রীকে একান্তই কৃপা না করলে সে ‘ফেল’ করত। তখনই আসত আভিভাবকদের কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত অনুরোধ । জানতে পারতাম কারো বাবা মাছ বিক্রী করেন, কারো মা বাড়ী বাড়ী কাজ করেন। এছাড়া কারখানায় কাজ করে অনেকেই। মেয়েকে কষ্ট করে পড়ান, তারা যদি একি ক্লাসে দু-বার করে পড়ে তাহলে পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে বা মেয়েকে কাজে লাগিয়ে দেবে! একেই তো মেয়ে, তায় আবার গরীব দেশের গরীব ঘরের মেয়ে!! বড় অসহায় লাগত তখন! দিদিমণিরা অনেকক্ষেত্রেই এসব কেসে ‘কনসিডার’ করে দিতেন। আদতে কিন্তু সেই পড়াশোনায় কাঁচা মেয়েটির কোনো লাভের লাভ হত না। এরা বেশির ভাগই আটকাতো ক্লাস নাইনে উঠতে গিয়ে। কারণ তখন বোর্ডের খাতায় নাম তোলার ব্যপার থাকে। আর তাই ‘দলছুট’ বা ইংরাজীতে যার পোশাকী নাম ‘dropout’ -এর সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি থাকে এখানেই। মনে আছে এক আভিভাবক এসেছিলেন মেয়ের এইট পাশের সার্টিফিকেট নিতে! ক্লাসে ফেল করায় কিছুতেই আর মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে রাজি নন!!

মেয়েরা যে চেষ্টা করত না তা-নয় কিন্তু! আমার লেখাটা পড়ে মনে হতেই পারে-কোন ‘ফেলু’ দের দিদিমণি ছিলাম বুঝি আমি!?কিন্তু, সমীকরণটা এতটাও সোজা ছিল না। একদিন ক্লাসে একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। পরে ওর বন্ধুদের থেকেই জানলাম বেশ কিছুদিন ধরেই দুপুরের দিকে মেয়েটার জ্বর আসে। ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাড়ীতে জানে, পাড়ার ডাক্তার দেখে কিছুই ধরতে পারেনি। হাসপাতালে check up করতে যাবে মাস পরলেই। আমি কখনো ওদের বাড়ীতে না গেলেও অনুমান করতে পারি, ওরা কতটা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে! শরীর খারাপ বলে প্রতিটি ক্লাসে প্রতিদিন 10-15 জন অনুপস্থিত থাকত। ক্লাস সিক্সে ইতিহাস পড়াতাম। একটি মেয়ে কোনদিন পড়া পারত না। একদিন ভীষণ বকলাম। জানতে চাইলাম বাড়ীতে কে পড়ায়? মা পড়ায় না? মেয়েটি মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। কোনো কথার উত্তর দেয় না, কেঁদেই চলে! তখন ওর বন্ধুরাই বলল, ওর বাড়ীতে কেউ পড়াশোনাই জানে না। সেটা নিয়ে ও লজ্জা পায়। কারণ সব টীচাররাই একি প্রশ্ন করে। আমার ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগল! ক্লাসের শেষে মেয়েটি ডেকে বোঝালাম, মা-বাবা যে কষ্ট করে ওকে পড়াচ্ছে, তাদের কথা ভেবে মন দিয়ে পড়তে বললাম। বললাম ‘নিজে ভালো করে না শিখলে মাকে কিকরে শেখাবে?’ তারপর থেকে প্রতিদিন ওর খোঁজ নিতাম ক্লাসে। ইচ্ছে করে ওকে সবচেয়ে সোজা প্রশ্নটা ধরতাম, পারলেই একটু বেশিই প্রশংসা করতাম। সাপ্তাহিক পরীক্ষায় ওর লেখার চেষ্টা দেখেই আমি ওকে ওর প্রাপ্য নম্বরের চেয়ে বেশী দিয়েছিলাম, যাতে ও উৎসাহ পায়। এবং তাতে কাজও হয়!
এক বছরের স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে জীবনের ঐ একটা বছর আমাকে একটা একদম নতুন অভিজ্ঞতা দিল। আমি যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে 100 জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে বসলে 90 জন-ই স্টার পায়। তারপর চাকুরী পেলাম সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে!কিন্তু সত্যি বলতে কী আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছিল আমার ঐ ছাত্রীরাই। যেটা ওদের দরকার ছিল, তা হল একটু ভালোবাসার, সঠিক guidance-এর। বকে-মেরে তো নয়-ই, ওদের মন জয় করতে পারলে, ওদের অসুবিধা টা feel করে ওদের বোঝালে, শেখালে ওরা ঠিক বুঝত বা শিখত। কিন্তু ক’জন সেভাবে ধৈর্য্য নিয়ে পড়াত ওদের? Corridor দিয়ে off period এ হাঁটলেই দেখতাম ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ, ঘরের ভেতর প্রচণ্ড মূর্তিতে অঙ্কের দিদিমণি স্কেল হাতে মারতে উদ্যত কাউকে!স্টাফরুমে খাতা দেখতে বসে কোনো কোনো টীচার ছাত্রীকে বড় বড় শূন্য দিতে পারলে আর কিছু চান না!! অবশ্য সবাই এমন নয়। মেয়েরা বই কিনতে পারে না, স্টাফরুমে পাঠ্যবই, সহায়ক বই-এর ছড়াছড়ি। পাবলিশার্স-রা টীচারদের নামে সবরকম বই-এর copy পাঠায়। এছাড়া ‘সর্বশিক্ষা’র টাকায় বই কেনে স্কুল। আসার আগে আমার ভাগের বই সব ছাত্রীদের দিয়ে এলাম। এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে দোষারোপ করা নয়। একটি বাস্তব খণ্ড চিত্রমাত্র। তিরিশ বছর ধরে যারা ঐ স্কুলে পড়াচ্ছেন তাদের মুখে শুনেছি আগে আরো খারাপ অবস্থা ছিল স্কুলটার । এখন তো তাও 5-6 জন star পায় মাধ্যমিককে । আর উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগটিও গত কয়েক বছর খোলার পর ভালোই ফল করছে। সেটাই আশার কথা। ঐ স্কুলটা-তে যদি চাকুরী সূত্রে না পৌঁছতাম, তাহলে পত্র পত্রিকাতে এই সংত্রান্ত রিপোর্ট গুলো পড়ে ভাবতাম এরা বাড়িয়ে লেখে বা হয়তো বিশ্বাস করতাম কিন্তু অনেক খবরের মত ঐ খবর গুলোও ভুলে যেতাম! কিন্তু এখন আমি অনুভব করতে পারি। কত মানুষ কত কষ্ট করে জীবনে কিছু করার চেষ্টা করছে। ওরা যেদিন সবাই আর ‘দলছুট’ হবে না, ওরা যেদিন সবাই আমাদের মতো ভাগ্যবান দেশবাসী হয়ে উন্নয়ন নামক গাছের ফলটা তারিয়ে তারিয়ে খাবে, সেদিন সত্যিই বলব আমাদের দেশ উন্নত হয়েছে! আর কোনো দলছুট -এর যেন না থাকে সেদিন কোনো স্কুলের খাতায়…. ।।





লেখিকা : মৌমিতা চৌধুরী
১০ই জুলাই, ২০০৮
মুম্বই, ইন্ডিয়া।

Sunday, August 10, 2008

ত্রিনয়ন :




বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজ মেলাবার আগেই এক দঙ্গল ছোট ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো গঙ্গায়। তাদের বয়স সাত থেকে পনেরো। মায়ের গয়না, অস্ত্র, কাঠামো, যে যা পারছে উদ্ধার করছে। স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে তারা কাড়াকাড়ির উল্লাসে মেতে উঠেছে। এর বিনিময় কিছু টাকা রোজগার করা যায় প্রতি বছর।

ভোলা এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। এই তার রোজগারের প্রথম প্রচেষ্টা। অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে কিছুই যোগার করতে পারলো না সে। ক্লান্ত ভোলা হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ডাঙ্গার কাছে পৌঁছে গেছে, ছোট্ট একটা মাটির ঢেলা হাতে এসে ঠেকলো। ভোলা তুলে নিয়ে দেখে মা দুর্গার ভাঙ্গা মুখ। একটা কান নেই, দু ছড়া চুল কোনোরকমে আটকে আছে, নাক চটে গেছে, একটা চোখ ধুয়ে বিবর্ণ। কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে দেখে, ত্রিনয়নীর তৃতীয় নয়ণ সজীব হয়ে জ্বলজ্বল করছে, যেন এইমাত্র তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে। ভোলা মুখখানা গামছায় বেঁধে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

আজকাল তার বাড়িতে থাকতে একদম ভাল লাগে না। রোজ রাতে বাবা মাতাল হয়ে মাকে অশ্রাব্য গালাগাল দেয়, মারধরও করে। মায়ের যন্ত্রনাকাতর চোখদুটো আর ছোট ছোট তিনটে ভাইবোনের ভয়ার্ত কান্না তাকে তাড়া করে ফেরে। পয়সার অভাবই যে সব কিছুর মূলে, ছোট্ট ভোলা তা বুঝে গেছে। তাই সে ঠিক করেছে কিছু রোজগার তাকে করতেই হবে। মায়ের স্বপ্ন ভোলা লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হলে তাদের দুঃখের দিনের অবসান ঘটবে।

সে রাতেও বাবার রণচন্ডি মূর্তি দেখে আর জড়ানো গলায় গালাগাল শুনে ভাইবোনেরা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বাবা টলতে টলতে এসে সজোরে তাদের গালে ঠাস ঠাস করে থাপ্পর মেরে মায়ের চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিলেন। সব মায়ের দোষ - বেকারত্ত্ব, এতগুলো অকালকুষ্মান্ড জন্ম দেওয়া, দুবেলা ঠিকমত খেতে না পাওয়া, সব সব।

ভোলা কানে আঙ্গুল দিয়ে ঘরের কোনায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সন্তর্পনে গামছা খুলে মায়ের মুখখানা চোখের সামনে এনে ফিসফিস করে বলল, তোমার তো তিনটে চোখ, কিছুই দেখতে পাও না?

হঠাৎ মায়ের ত্রিনয়ন থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে চারিদিক আলোকিত করে তুললো। যেন হাজার ঢাকে কাঠি পড়লো। শঙ্খ আর উলুদ্ধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিতো। পুরুত মশাইয়ের ধুঁনুচির ধোয়ায় সামনেটা আচ্ছন্ন।

ধীরে ধীরে ধোঁয়ার পর্দা সরে গেল। নজরে এল টলটলে একটা দীঘি, নারকেল গাছের সারি। ধবল গাইরা কৃষ্ণচূড়া গাছে তলায় বসে নিশ্চিন্তে জাবর কাটছে। দীঘির ধারে ওরা কারা বসে? হ্যাঁ, ঐ তো তার মা বাবা! বাবার পরনে পরিষ্কার হাফ হাতা শার্ট আর পাজামা। মায়ের চুলে বাহারি খোঁপা, গায়ে ডুরে শাড়ী। ভালবাসার প্রতীক যেন তারা। হাতে হাত রেখে মা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে নতমুখে বসে আছেন আর বাবা সজত্নে তাঁর কপালে উড়ে আসা চুল সরিয়ে দিচ্ছেন।বাবা মাকে এত ভালবাসেন? তাহলে এখন কেন এমন বদলে গেছেন? অভাব? ব্যর্থতা? অক্ষমতা? তাই হবে!

ঐ তো! মাঠে ওরা চার ভাইবোন খেলা করছে। সকলের গায়ে ফর্সা ছিটের জামা, মুখে তৃপ্তির হাসি। রঙ্গিন প্রজাপতির মত ছুটে বেড়াচ্ছে। খেলতে খেলতে ছুটকি পড়ে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। মা বাবা ছুটে এলেন ওদের কাছে। বাবা ছুটকিকে কোলে তুলে একটা হামি দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। ওমনি ছুটকি চুপ। বাবার গলা জড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

চার ভাইবোন মা বাবার হাত ধরে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরলো। তারপর মা যত্ন করে কত কি রাঁধলেন! ডাল, শুক্ত, মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস। এত সব খাবার একসাথে কখনই খায়নি তারা। মায়ের হাতের রান্নার কি স্বাদ! সকলকে বেড়ে ছুটকিকে খাওয়াতে বসলেন মা। ভোলা তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতে দেখলো বাবা মায়ের দিকে চেয়ে হাসছেন আর বলছেন, অনেক পুণ্যি করে তোমায় পেয়েছি। মায়ের মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।

খাওয়া দাওয়া সেরে ভাইবোনেরা মা বাবার মাঝখানে শুয়ে পড়লো। কত গল্প শোনালেন ওঁরা। রাজা রানির গল্প, রাক্ষসের গল্প, পরিদের গল্প। শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দুটো ঘুমে ভারি হয়ে এসেছে টেরই পায়নি ভোলা।

ঝনঝন করে বাসন ছোঁড়ার আওয়াজ আর মায়ের ‘উফ!মা গো!’ বলে রক্তাক্ত কপাল চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না ভোলার কানে পৌঁছালো না।

সে এখন মা দুর্গার তৃতীয় নয়নের আলোকপথ ধরে দূর রাজ্যে পৌঁছে গেছে, যেখানে সে ভালবাসার আলো গায়ে মেখে, ফুসফুস ভরে বিশ্বাসের বাতাস টেনে সুখের ঘাস-গালিচায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ভোলার আলগা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয় মায়ের ভাঙ্গা মুখে, ত্রিনয়নের উপর টলটল করছে ওর চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া এক বিন্দু জল।




লেখিকা : শর্মিলা দাশগুপ্ত
১১ই জুলাই ২০০৮
দিল্লী, ইন্ডিয়া।

Saturday, August 9, 2008

এত টুকু বাসা :




মেদিনীপুর গামী লোকাল ট্রেনটা হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। লেডিজ কামরায় জানালার ধারে একটি মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির গভীর চোখ দুটিতে বিষাদের ছায়া সুস্পষ্ট। মেয়েটির নাম বৈশালী।

ছোট বেলা থেকে অনেক ঝড় ঝাপ্টা ওর জীবন কে প্রতি মুহূর্তে চুরমার করে দিয়েছে। একদম ছোট্ট বেলায় তার বাবার মৃত্যু তাকে প্রায় অনাথ করে দিয়েছিল। তার মাও তার বাবার মৃত্যুর কিছু দিন বাদেই অন্য এক পুরূষের সঙ্গে কোন এক রাতে বৈশালী কে একা ফেলে রেখে কোথায় চলে যায়। সেই থেকে এই বিশাল পৃথিবীতে ছোট্ট বৈশালী্র একা একা সংঘর্ষের শুরু। অনাথ বৈশালী কে এরপর তার কাকা কোন রকমে একটু দয়া করে আশ্রয় দেন। নিছক এক আশ্রিতার মতো বৈশালী তার কাকা কাকিমার কাছে মানুষ হতে থাকে। বহু কষ্টে নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় সে বেশ ভালো ভাবেই স্কুলের গণ্ডি শেষ করে। কিন্তু তারপর তার কাকা কাকিমা কিছুতেই বৈশালীকে আর পড়তে দিতে চাইলেন না। অনেক মিনতী করে বৈশালী নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাবার প্রতিশ্রুতি দেবার পর কোন রকমে তাকে তাঁরা পড়াশনার অনুমতিটুকু দেন।

সারা দিন কলেজ করে সন্ধে বেলা চারটে টিউশন সেরে রাত ৯টায় বাড়ি ফিরে তার কাকিমার গঞ্জনা শুনতে শুনতে ঘরের সব কাজ শেষ করে বৈশালী রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এই রকম কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে সে কলেজের পড়াশোনাও শেষ করে ফেলে। সে চায় আরও পড়াশোনা করতে। কিন্তু এইবার আর তার কাকা কাকিমা তাকে দয়া করেন না। তাকে পত্রপাঠ জানিয়ে দেন যে তাঁরা আর তার ভার বহন করতে পারবেন না। বৈশালী কে এবারে নিজের জীবন নিজেই চালিয়ে নিতে হবে। হাজার অনুনয় বিনয়তেও তাঁরা আর কোন কর্ণপাত করেন না। সৃষ্টিকর্তা আরও একবার তাকে নিরাশ্রয় করে দিলেন।

বৈশালী বুঝতে পারেনা এই কঠিন পৃথিবীতে কোথায় সে এতটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে? কটা টিউশন করে তার যতসামান্য যা আয় হতো তাই দিয়ে তো কোথাও আশ্রয় পাওয়া সম্ভব নয়? কি করবে এখন সে? সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এই সময় বৈশালী কে সামান্য কৃপা করলেন। তার স্কুলের এক পুরানো বান্ধবীর বাড়িতে কিছুদিনের জন্যে একটু আশ্রয় তার জুটে গেল। এবার বৈশালী পাগলের মতো একটা চাকরির খোঁজে দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। অবশেষে একটি স্কুলে সামান্য মাইনের একটা চাকরি জোটাতে সক্ষম হয় সে। তারপর সেই বান্ধবীর বাড়িতেও আর তার ঠাঁই হয় না। সেখান থেকেও বিতাড়িত হতে হয় তাকে। বহু কষ্টে একটি লেডিজ হস্টেলে আশ্রয় নেয় সে। কিন্তু, ওই স্কুলের চাকরির সামান্য মাইনের চাকরিতে লেডিজ হস্টেলের খরচ চালান তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না কোন মতেই। তাই বৈশালী আরও একটু ভাল চাকরির চেষ্টা করতে থাকে।

এইরকমই কোন একদিন চাকরির খোঁজে ঘুরতে গিয়ে কুণালের সঙ্গে বৈশালীর পরিচয় ঘটেছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান কুণালও অনেক সংঘর্ষ করে জীবনযুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করাবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। বৈশালীর কুণাল কে দেখেই ভীষন ভাল লেগেছিল তাই দুজনের মধ্যে ভালবাসা গড়ে উঠতে বেশী সময় লাগেনি। পৃথিবীতে দুটি হৃদয় মিলিত হয়ে জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। দুটি সুন্দর মন অনেক রঙীন স্বপ্ন বোনে। তারা এক প্রাণ হয়ে একটি সুখের নীড় গড়তে চায়। বৈশালী বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় মোটামুটি একটি ভাল স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু কুণাল বহু চেষ্টা করেও কোন চাকরি পায় না। দিনের পর দিন ব্যর্থতা কুণাল কে অধৈর্য্য করে তোলে। কুণাল মানসিক ভাবে ভীষন ভেঙ্গে পড়ে। বৈশালী ক্রমাগত কুণালকে উৎসাহ প্রদান করে যায়।

একদিন সত্যি সত্যি অন্ধকার রাতের অবসান ঘটে ভোরের নতুন সূর্য্য দুটি জীবন কে আলোকিত করে তোলে। কুণাল একটি ভালো কোম্পানিতে চাকরি পায়। সেদিন কুণালের জীবনে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। খুশীর জোয়ারে ভাসতে ভাসতে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে বৈশালী কে খবরটা জানায় কুণাল। কুণাল বৈশালীকে বলে, “তুমি তৈরী থাকো আমি আসছি তোমার সাথে দেখা করতে”...

বৈশালী ভেবে পায় না সে আনন্দে কি করবে। জীবনে এই প্রথম সে সুখের আস্বাদ পেলো... সুখ কি জিনিষ তা অনুভব করল। তার মনে হল এতদিন জীবনে সে যত দুঃখ পেয়েছে সেই সবের যেন আজকে অবসান ঘটল। আজ নিজেকে তার পরিপূর্ণ মনে হতে লাগল। আজ তার প্রথম মনে হল আয়নায় নিজেকে নিরীক্ষণ করবার কথা। আয়নার সামনে বসে বৈশালী অনেক্ষন চেয়ে থাকল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। জীবনে কত দুঃখ সে পেয়েছে কিন্তু কখনও সে হার স্বীকার করেনি একভাবে লড়াই করে গেছে জীবনের প্রতিটি দুঃসময়ে। আজ আয়নায় নিজেকে বেশ সুন্দর মনে হচ্ছিল বৈশালীর। নিজেকে এই প্রথম বৈশালী খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলল। তারপর অধীর আগ্রহে কুণালের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। আজ সময় যেন কাটতে চাইছেনা। বৈশালী বারে বারে ঘড়ি দেখে আর ছটফট করতে থাকে কখন কুণাল কে আজকে সে কাছে পাবে? কিন্তু সময় বয়ে যায়, কুণাল আসেনা। বৈশালী পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে কুণালের জন্যে। ভেবে পায় না সে কিভাবে কুণালের খবর নেবে কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবে?

এই সময় হঠাৎ বৈশালীর মোবাইল ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে। বৈশালী চমকে ওঠে। কোন এক অজানা আতঙ্কে বৈশালীর মন কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে ফোনটা কানে দিয়ে “হ্যালো” বলে সে। ওপার থেকে কোন এক অজানা কন্ঠস্বর ভেসে আসে...হ্যালো আমি পিজি হাসপাতাল থেকে বলছি...কিছুক্ষন আগে এক ভদ্রলোকের বাস অ্যাক্সি্ডেন্টে মৃত্যু ঘটেছে। তার পকেটে মানিব্যাগের মধ্যে এই ফোন নম্বরটা পেয়ে আপনাকে খবর দিচ্ছি আপনি দয়া করে এখানে এসে লাশটা একটু শনাক্ত করে যান...

বৈশালীর কানে কোন আওয়াজ আর পৌঁছাচ্ছে না। তার কানের ভেতর মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য হর্ণের আওয়াজ হয়ে চলেছে। বৈশালী খালি দৌড়ে চলেছে যানে না কোথায়? হঠাৎ বৈশালী দেখল যে সে হাসপাতালের মর্গের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে আর তার সামনে কুণালের দোমড়ানো মোচড়ানো দেহটা পড়ে রয়েছে। বৈশালী পাথরের মত সেদিকে চেয়ে আছে। পৃথীবিটা আজ তার চোখের সামনে যেন ভীষন দুলছে। ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাটতে লাগল সে। জানেনা কোথায় চলেছে সে। আজ সে বড় ক্লান্ত। আজ বৈশালী আবার নিরাশ্রিত।

কিছুদিন আগে ঝাড়গ্রামের একটি স্কুল থেকে চাকরির একটা প্রস্তাব পেয়েছিল বৈশালী। কিন্তু কুণাল কে ছেড়ে থাকতে পারবেনা বলে চাকরিটা তখন নেবেনা ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন আর বৈশালীর কোন পিছু টান নেই। তাই কোলকাতা শহরকে আজ চিরতরে বিদায় জানাতে চলেছে সে। শূণ্য বুকে বিষাদ কে স্মৃতি করে আজকে বৈশালী আবার চলেছে নতুন বাসার খোঁজে নতুন দিশার দিকে।

ট্রেনটা সশব্দে হর্ণ বাজিয়ে নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেনটা চোখের বাইরে চলে গেল...।





লেখিকা : শুচিস্মিতা (ঝুম) সেন
১২ই জুলাই, ২০০৮
দোহা, কাতার।

Friday, August 8, 2008

অজানা হাতছানি :




অনূসুয়া, পৌলমী ও রক্তিমা —প্রায় ১০ বছর পর আবার আজ মুখোমুখি, কলেজের শতবার্ষিকী মিলনমেলায় । এতগুলো বছর পরে একে ওপরকে দেখে উল্লসিত। হঠাৎই যেন তারা ফিরে যায় সেই ১০বছর আগের দিন গুলোতে। চোখের সামনে থেকে সরে যায় ১০ বছর, মন থেকে সরে যায় ১০ বছরের ব্যবধান। মনে পরে যায় সেই দিনের কথা যখন তারা সদ্য কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দেওয়া প্রানবন্ত তিন তরুণী। প্রত্যেকের চোখে রঙীন স্বপ্ন আর উজ্জ্বল ভবিষ্যত। কলেজে ঢুকেই এদের বন্ধুত্ব শুরু, কিন্তু কিছু দিনেই মধ্যেই ওরা হয়ে ওঠে হরিহর আত্মা। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে ক্যান্টিন সব জায়গাতেই একসাথে উপস্থিত এই তিন মূর্তি। পড়াশুনা, আড্ডা, সিনেমা দেখা, একসাথে শপিং করা এভাবেই আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে যেতে থাকে। নিজেদের সুখ দুঃখের কথা এরা বিনা সঙ্কোচে একে ওপরকে বলে। তবে এদের মধ্যে যে তর্ক বিতর্ক হতো না সেটাও ঠিক না। একটা ব্যাপার নিয়ে এদের মধ্যে সর্বদা তর্ক বিতর্ক লেগেই থাকত ,তা হল “love marriage” না “arrange marriage” কোনটা ঠিক? পৌলমী ও রক্তিমা’র মতে একজনকে না জেনে শুনে বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না আর অনূসুয়ার মতে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূ্র্ণ সিদ্ধান্ত মা-বাবার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। এই নিয়ে তর্ক শুরু হলে তার নিষ্পত্তি কোন দিনই হতো না। কেউ কারো মত থেকে এক চুলও সরতো না। এভাবেই ভালোবাসা ,বন্ধুত্ব তর্ক ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে এদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে।

হঠাৎই একদিন সকালে রক্তিমার ফোন অনূসুয়া ও পৌলমীকে “আজ একটু তাড়াতড়ি কলেজে আসবি জরুরী দরকার আছে”। অনূসুয়া ও পৌলমী তো ভীষন কৌতুহলী হয়ে সাত তাড়াতাড়ি কলেজ পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে রক্তিমাও এসে যায়। এসে সে জানায় আজ সে অবশেষে দেখা করতে যাচ্ছে তার সাথে। এই তিনি হলেন রক্তিমার “chat friend” ইন্দ্রজিত I.S.I এর এক কৃতি ছাত্র। প্রায় ১ বছর ধরে চ্যাট করার পর আজ অবশেষে দেখা করার সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে দুজনে। আজ বেশ সেজে এসেছে রক্তিমা,বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে ওকে। অনূসুয়া ও পৌলমী তো খুব খুশী, তারাই বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। কলেজ ছুটির পর রক্তিমা গেল দেখা করতে আর অনূসুয়া ও পৌলমী বাসে এই নিয়েই আলোচনা করতে থাকল। একজন বলে আজই ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে মনে হয়,আর একজন বলে ওঠে সেটা কখনই উচিৎ না আরও কছুদিন দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এভাবে যে যার বাড়ীতে পৌঁছে যায়। পরের দিন সকালে আবার তারা খুব উৎসাহে কলেজে আসে রক্তিমা এসে জানাই কাল বিকালটা বেশ ভালই কেটেছে,ইন্দ্রজিৎ বেশ ভালো ছেলে কিন্তু সে যেমন জীবনসঙ্গী চায় তেমন না,বন্ধু হিসাবে ঠিক আছে। অনূসুয়া ও পৌলমী ওর সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। আবার কিছুদিন পরেই সকালে রক্তিমার ফোন অনূসুয়া ও পৌলমীকে “একটা খুশীর খবর আছে তবে এখন বলব না সামনাসামনি বলব, অনূসুয়া ও পৌলমী বাসে যেতে যেতে ভাবে হয়ত ইন্দ্রজিৎ’কে নিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত রক্তিমা পাল্টেছে। কলেজে পৌঁছে দেখে রক্তিমা একা ক্লাসে বসে আছে। ওরা যেতেই রক্তিমা জানায় তার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে পাত্র Software Engineer পরের বছর U.K যাবে। ছেলেটির সাথে কথা বলে ওর ভালো লেগেছে ও বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে। অনূসুয়া ও পৌলমী তখন বিস্ময় কাটিয়ে বিয়েতে কী কী করবে তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করে দেয়। অবশেষে বিয়ের দিন এসে যায়, ওরা খুব আনন্দ করে।

কিছুদিন পর পৌলমী্ একদিন কলেজে আসে প্রচন্ড থমথমে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমোয়নি। রক্তিমা ও অনূসুয়া জিজ্ঞেস করতে থাকে কী হয়েছে? অনেকক্ষণ পরে সে জানায় তার বয়ফ্রেন্ড (প্রসুন) কাল চাকরী নিয়ে ম্যাঙ্গালোর চলে গেছে। রক্তিমা ও অনূসুয়া ওকে বোঝাতে থাকে যে কটা মাত্র দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ওরা পৌলমীকে বেশী করে সময় দিতে থাকে। এভাবেই কলেজের শেষদিন এসে যায়। প্রত্যেকের খুব মন খারাপ আর রোজ দেখা হবে না। তাও এটাই নিয়ম সবাইকেই মেনে নিতে হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ২ দিন পর আবার সবার দেখা এয়ারপোর্ট-এ, রক্তিমা চলে যাচ্ছে ওর বরের কাছে U.K। এখন অনূসুয়া ও পৌলমী রোজ দেখা করে গল্প করে ঘুরতে যায়। হঠাৎই এরমধ্যে পৌলমী এসে জানায় প্রসুনকে U.S.A যেতে হবে যাওয়ার আগে ওরা বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়। খুব তাড়াতাড়ি ওরা বিয়ে করে U.A.S’র উদ্দ্যেশে রওনা হয়ে যায়। অনুসূয়া ওদের তুলে এসে ভীষণ মনমরা হয়ে পড়ে,সে যে আজ ভীষণ একা হয়ে গেল।

এরপর অনুসূয়ার বাড়ী থেকে বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হয়ে যায়, কিন্তু তার কাউকেই পছন্দ হয় না, হবেই বা কী করে তার মন যে অন্য খানে বাধা। কিন্তু সে নাম জানে না তার, জানে না সে থাকে কোথায় । তাকে সে দেখোওনি কোনদিন, দেখেছে শুধু স্বপ্নে। যে স্বপ্নটা আজ মাস ছয়েক ধরে তাকে ঘুমোতে দেয়নি। স্বপ্নের কথা সে জানাতে পারেনি কাউকে এমনকি তার বন্ধুদেরও না। তবে সে এই ছয় মাসে সে ছেলেটির সাথে অনেক জায়গায় বেড়াতে গেছে, অনেক সুখ দুঃখের কথা বলেছে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে তাকে, সে স্বপ্নই হোক তাতে কী যায় আসে। তারপক্ষে অন্য কোন ছেলেকে মেনে নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু বাড়ীর সবাইকে বোঝানো সম্ভব না আর সে বোঝাবেই বা কী? তাই সে কোনো ছেলেকেই পছন্দ হচ্ছে না এই অজুহাত দিতে থাকে। বাড়ীর সবাই খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে তার ওপর। তারা পাত্র দেখাও ছেড়ে যায়। কিন্তু তারা লক্ষ্য করতে থাকে অনুসূয়া দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। তাকে জোর করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় শারীরিক কিছুই অসুবিধা ধরা পরে না, তবে ডাক্তার অনুসূয়া’র সাথে কথা বলে বোঝে অসুস্থতাটা শারীরিক না মানসিক। তাই তিনি অনুসূয়া’র মা-বাবাকে পরামর্শ দেন কোনো মনবিদ এর পরামর্শ নিতে। অনুসূয়া’র বাবা মা এতে কোনো আমল না দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। তবে যতদিন যায় অনুসূয়া’র শরীর ততই খারাপ হতে থাকে তখন নিরূপায় হয়ে তারা মনবিদ এর শরণাপন্ন হন। তিনি অনুসূয়া’র সাথে কথা বলে আসল ব্যাপার জানতে পারে। তিনি অনুসূয়া’র বাবা মাকেও জানায় পুরো ঘটনাটা। তারা সবাই মিলে অনুকে বোঝাতে থাকে, বেশ কিছুদিন পরেও অবস্থা একই থাকে। শেষে তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।mদীর্ঘ ২ বছর চিকিসা হওয়ার পর সে অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়ী ফেরে। তবে সে ঠিক করে যে বিয়ে করবে না। একটা স্কুলেও চাকরী পেয়ে যায়। এভাবেই তার দিন কাটতে থাকে। হঠাৎই একদিন খবরের কাগজে দেখে তাদের কলেজে শতবার্ষিকী মিলনমেলা হচ্ছে। আর সেখানে গিয়েই আজ এতবছর পর দেখা হলো তিন বন্ধুর।

সবাই যে যার জীবনের গল্প করতে থাকে। রক্তিমা ও পৌলমী তাদের সংসার, বর, সন্তান তার পড়াশুনা, শ্বশুড়বাড়ীর সুবিধা-অসুবিধা এইসব নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এখানে অনুসূয়া নীরব শ্রোতা, তার বলার কিছু নেই। সে তার স্কুলের কথা বলে। এভাবেই প্রায় কেটে যায় ৬ ঘন্টা। এবার বাড়ী ফেরার পালা। অনুসূয়া বাসে আস্তে আস্তে ভাবে তারও একটা সংসার হতো, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করতে পারত। তার বাবা-মাকেও একটু শান্তি দিতে পারত, তার জন্য ভেবে ভেবে বাবা-মা যেন বয়সের আগেই বেশী বুড়িয়ে গেছে। সে বাসে বসেই সিদ্ধান্ত নেয় এবার সে তার স্বপ্নের পুরুষকে ভুলে অন্য একজনকে সেই স্থান দেবে। আজ এই কথা শুনলে তার বাবা-মা কতোই না খুশি হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে সে বাস থেকে নেমে বাড়ীর দিকে হাটতে থাকে। সামনের একটা গাড়ী থেকে নেমে একটি ছেলে অনুসূয়ার উল্টোদিক থেকে আসার সময় অনুসূয়ার অন্যমনস্কতার জন্য ছেলেটি তার সাথে ধাক্কা খায়। অনুসূয়া ফিরে ছেলেটিকে দুঃখিত বলতে গিয়ে চমকে ওঠে, মনে মনে বলে ওঠে “আরে এই তো আমার স্বপ্নে দেখা পুরুষ”। ছেলেটিও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অনুর দিকে। তাহলে কি ছেলেটিও এতদিন তার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। অনুসূয়া দেখে তার সামনে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে কিছু না ভেবেই অজান্তেই বাড়িয়ে দেয় তার হাতখানি তার স্বপ্নের পুরুষের দিকে।





লেখিকা : অর্পিতা পান্ডা(রায়)
১২ই জুলাই, ২০০৮
ব্যাঙ্গালোর, ইন্ডিয়া।

Thursday, August 7, 2008

পুজোর প্রাপ্তি :



সকাল থেকে একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টি সন্ধ্যের দিকে মুষল আকার নিলো। দাদা কাজ থামিয়ে বাইরের দিকে একবার তাকালো। আনমনা হয়ে বলল “কয়েক বছর ধরে এই শুরু হয়েছে, পুজোর আগে এই সময়ে সারাদিন ধরে বৃষ্টি!” দাদা একমনে চড়া ২টো বাল্বের আলোয় টুলের ওপর দাঁড়িয়ে মা দুর্গার চোখ আঁকতে ব্যস্ত। আমি তার পেছনে একটা ছোট্ট জলচৌকিতে বসে বসে তা দেখে চলেছি। আমার কাজ ই এই সময় হলো তার ফাই ফরমাশ খাটা। এই যেমন হয়তো কখনো বললো “ওই মোটা তুলিটা আমার হাতে দে তো” বা "ওই জরিটা বেশ হবে লাগালে, আনতো ধরে দেখি”। তার পরেই হয়ত চাইলো আঠা। কখনো কখনো দাদা যে এসব বিষয়ে আমারও পরামর্শ নেয় না, তা নয়। যদিও আমি ওর চেয়ে প্রায় ৯-১০ বছরের ছোট। কখনো বেশ উৎসাহী হয়ে বলি “এটার থেকে ওই জরিটা” বা “এই কাপড়টা দিয়ে মায়ের শাড়ী করো না, খাসা লাগবে”। এসব আবদারে দাদা মুচকি হেসে বলে “বাজেটটা তো দেখতে হবে”। ওর এসব কথার অর্থ আমি ঠিক বুঝিনা। তবে আমার সবচেয়ে মজা লাগে যখন ও আমায় বলে কাছের দোকান থেকে হুবহু কোনো চুমকি বা জরি এনে দিতে। আমি এক ছুট্টে সেখানে যাই, দোকানটা আমার বেশ পছন্দের। এত রকমারি চুমকির সম্ভার, সেসব থেকে আলো ঠিকরে পরে। আমি এক ধরনের জিনিস দেখতে গিয়ে দশ ধরনের জিনিস দেখে ফিরি। অবশ্য খুব কম সময়ই নিই দাদার ভয়ে। কখনো কখনো নতুন কিছু খুব ভালো লেগে গেলে দাদাকে নিয়ে এসে দেখাই। দাদাও বেশ খুশিই হয় মনে মনে। দাদা তিন চার বছর হলো দুর্গা ঠাকুর বানাচ্ছে, বাবা চলে যাবার পর। অবশ্য এর আগে ছোট খাটো প্রতিমা গড়ে হাত পাকিয়েছে আর ঠাকুরের দয়ায় সারা বছর তো একটা না একটা পুজো লেগেই রয়েছে। বাবা কাকার কাছে থেকে থেকে ও এই কাজ শিখেছে। প্রতিমা তৈরীতে ওর এ পাড়ায় বেশ নামডাক।

পুজো উপলক্ষ্যে আমার একটা নতুন শার্ট প্রাপ্তি হয়েছে। দেখতে দেখতে পঞ্চমী এসে গেল । দাদা যে প্রতিমা গুলো বানানোর ভার নিয়েছিলো, তাদের মধ্যে যেটা আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিলো, ক্লাবের লোকেরা সদলবলে নিয়ে গেল। আমি দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে দেখলাম। ভীষণ রাগ হচ্ছিল লোকগুলোর ওপর। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমার ছোট্ট হাতে এতবড় প্রতিমাকে আটকে রাখা কোনো রকমে সম্ভব না, কিন্তু দাদা ওই একই রকম নির্বিকার, যেমন নির্বিকার ছিলো সে এই প্রতিমা তৈরীর সময়। লোকগুলোর দাঁত বের করা হাসি দেখে মনে হলো বেশ পছন্দ হয়েছে দাদার কাজ। বাকি টাকা দিয়ে তারা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো। মা দুর্গার পর একে একে লক্ষ্মী, সরস্বতী সবাই ট্রাকে উঠল। চারপাশ সমবেত চিৎকারে ভরে গেল, -দুর্গা মা কি জয়!!

দ্রুত এলো ষষ্ঠী, এলো সপ্তমী। সেদিন বিকালে হঠাৎ দাদা আমায় আর রিনা-দুই ভাই বোনকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গেল। নতুন শার্ট পরে আমার সেদিন সে কি আনন্দ! আমার সেই প্রিয় প্রতিমার স্থান হয়েছে ‘সকলের ক্লাব’ এ। লাইটিং দেখে তো আমি থ। বরফের মতো স্বচ্ছ প্যান্ডেল, চারপাশ থেকে হাল্কা হাল্কা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। প্যান্ডেলে ঢোকার জন্য এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে লাইন ছাড়িয়ে চলে গেছে। একটু বাদে বাদে ২০-২৫ জন করে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে ।

বহু কষ্টে আমরা প্যান্ডেলে তো ঢুকলাম, চারিদিকে রকমারি আলো। তা বরফের স্ল্যাবে পরে মায়াবি পরিবেশ করে তুলেছে। চকমকে শাড়ী, পোশাকে সবাই ভীড় করেছে। দাদার হাত ধরে ভীড় ঠেলে কোনরকমে ঢুকছি। আমরা যে এই ঝাঁ চকচকে ভীড়ে বেশ বেমানান তা লোকেদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু সবশেষে মা দুর্গা ও তার পরিবারের লোকজনের দিকে তাকানোর পর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল এতক্ষণে আমরা আমাদের পরম আত্মীয়দের এই ভীড়ে খুঁজে পেয়েছি।



প্রিয়াঙ্কা সান্যাল
মিনেপলিস, আমেরিকা
২৫শে জুলাই, ২০০৮