Monday, August 11, 2008

দলছুট


আমাদের মেয়েবেলায় কখনো এমন হয়নি যে টাকার অভাবে বই কিনতে পারিনি বা স্কুলের মাইনে দিতে পারিনি। তাই এর পরবর্তী ধাপগুলো সম্বন্ধে আরোই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। শহর কলকাতার স্কুলে পড়াশোনা করে এবং মোটামোটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে কোনোদিন ভাবিনি, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে/মফঃস্বলে এমনকি বহু শহরতলি এলাকাতেও অনেক পরিবারে অনেক ছেলে-মেয়ে শুধুমাত্র অর্থের সংস্থান করতে পারে না বলে মাঝপথে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

বছর বছর অনেক কৃতি ছেলে-মেয়ে বিদেশে পারি দেয় উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে। একদল পড়াশোনা শেষে নিজের মনের মতো বৃত্তি যোগার করে নিয়ে খুশী হয়। আগে যেমন শুনতাম, এখন দিনকাল অনেক পাল্টেছে, এখন এদেশে চাকুরীর বাজারটা তেমন মন্দার আর নয়। বহুজাতিক সংস্থার দৌলতে দেশের অর্থনীতির বাজারে জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মের জন্য চাকুরির সুয়োগ বেড়েছে। তাই এককালে যেমন ছিল ক্লাসের প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় স্থানপ্রাপকরাই জীবনে খুব সফল, উচ্চপদে কাজ করছে-চিত্রটা আর তা নয়। এখন মাঝারি তো বটেই এমনকি স্কুলে সবচেয়ে পেছনের দিকের ছেলেটাও ভালো চাকুরী পায়। সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে দেশের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে গত দুইদশকে। এ বড় ভালো লক্ষণ আমাদের দেশের জন্যে।

আমার এই লেখাটা যদিও ‘দলছুট’দের নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় ছোট থেকে পড়াশোনা করেছি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি স্কুলে এক বছর চাকুরীর সুবাদে এখানে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখতে চাই। আমি যে স্কুলে চাকুরী করতাম সেটি হাওড়া স্টেশন থেকে মিনিট দশ-পনেরো দূরে সালকিয়া বলে একটি অঞ্চলে। সাধারণ স্কুল, যারা স্কুলে পড়তে আসে তারা বেশির ভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত/ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তা বলে খুঁজলে কাউকেই স্বচ্ছল পরিবারের পাওয়া যাবে না, তাও নয়। এরা ইংরাজীতে কাঁচা। ক্লাস ফাইভের ইংরাজী ক্লাস নিতে গিয়ে দেখেছি গোটা ক্লাসে দু-তিনজন ছাড়া কেউ শুদ্ধ বাক্য লিখতে পারে না। অনেককেই আবার ABCD থেকে শুরু করতে হচ্ছে। মাতৃভাষায়-ও যে খুব দখল আছে, তা নয়। সবমিলয়ে 60+60+60=180 জন মেয়ে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষা যখন তারা দিতে বসে সংখ্যাটা দাঁড়ায় 90-100 জন! কোথায় যায় বাকী 80 জন? আমি এই প্রশ্নটা একবার শুরুরদিকে করেছিলাম এক সিনিয়ার সহশিক্ষিকাকে। তিনি বলেছিলেন ‘থাকতে থাকতে সবই বুঝে যাবি।’ ঐ একবছরে কিছুটা বুঝেছিলাম--অনেকটাই বুঝিনি!!

খুব ভালো করে চিত্রটা পরিস্কার হল বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট তৈরির সময়টাতে। ক্লাস সেভেন অবধি তিনটি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েও সেই ছাত্রী নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হবার ছাড়পত্র পেত! ইংরাজী অঙ্ক বিজ্ঞানে পাশ না করেও দিব্যি ক্লাসে উঠে যাওয়া যেত! ক্লাস-টীচার কোনো ছাত্রীকে একান্তই কৃপা না করলে সে ‘ফেল’ করত। তখনই আসত আভিভাবকদের কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত অনুরোধ । জানতে পারতাম কারো বাবা মাছ বিক্রী করেন, কারো মা বাড়ী বাড়ী কাজ করেন। এছাড়া কারখানায় কাজ করে অনেকেই। মেয়েকে কষ্ট করে পড়ান, তারা যদি একি ক্লাসে দু-বার করে পড়ে তাহলে পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে বা মেয়েকে কাজে লাগিয়ে দেবে! একেই তো মেয়ে, তায় আবার গরীব দেশের গরীব ঘরের মেয়ে!! বড় অসহায় লাগত তখন! দিদিমণিরা অনেকক্ষেত্রেই এসব কেসে ‘কনসিডার’ করে দিতেন। আদতে কিন্তু সেই পড়াশোনায় কাঁচা মেয়েটির কোনো লাভের লাভ হত না। এরা বেশির ভাগই আটকাতো ক্লাস নাইনে উঠতে গিয়ে। কারণ তখন বোর্ডের খাতায় নাম তোলার ব্যপার থাকে। আর তাই ‘দলছুট’ বা ইংরাজীতে যার পোশাকী নাম ‘dropout’ -এর সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি থাকে এখানেই। মনে আছে এক আভিভাবক এসেছিলেন মেয়ের এইট পাশের সার্টিফিকেট নিতে! ক্লাসে ফেল করায় কিছুতেই আর মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে রাজি নন!!

মেয়েরা যে চেষ্টা করত না তা-নয় কিন্তু! আমার লেখাটা পড়ে মনে হতেই পারে-কোন ‘ফেলু’ দের দিদিমণি ছিলাম বুঝি আমি!?কিন্তু, সমীকরণটা এতটাও সোজা ছিল না। একদিন ক্লাসে একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। পরে ওর বন্ধুদের থেকেই জানলাম বেশ কিছুদিন ধরেই দুপুরের দিকে মেয়েটার জ্বর আসে। ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাড়ীতে জানে, পাড়ার ডাক্তার দেখে কিছুই ধরতে পারেনি। হাসপাতালে check up করতে যাবে মাস পরলেই। আমি কখনো ওদের বাড়ীতে না গেলেও অনুমান করতে পারি, ওরা কতটা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে! শরীর খারাপ বলে প্রতিটি ক্লাসে প্রতিদিন 10-15 জন অনুপস্থিত থাকত। ক্লাস সিক্সে ইতিহাস পড়াতাম। একটি মেয়ে কোনদিন পড়া পারত না। একদিন ভীষণ বকলাম। জানতে চাইলাম বাড়ীতে কে পড়ায়? মা পড়ায় না? মেয়েটি মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। কোনো কথার উত্তর দেয় না, কেঁদেই চলে! তখন ওর বন্ধুরাই বলল, ওর বাড়ীতে কেউ পড়াশোনাই জানে না। সেটা নিয়ে ও লজ্জা পায়। কারণ সব টীচাররাই একি প্রশ্ন করে। আমার ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগল! ক্লাসের শেষে মেয়েটি ডেকে বোঝালাম, মা-বাবা যে কষ্ট করে ওকে পড়াচ্ছে, তাদের কথা ভেবে মন দিয়ে পড়তে বললাম। বললাম ‘নিজে ভালো করে না শিখলে মাকে কিকরে শেখাবে?’ তারপর থেকে প্রতিদিন ওর খোঁজ নিতাম ক্লাসে। ইচ্ছে করে ওকে সবচেয়ে সোজা প্রশ্নটা ধরতাম, পারলেই একটু বেশিই প্রশংসা করতাম। সাপ্তাহিক পরীক্ষায় ওর লেখার চেষ্টা দেখেই আমি ওকে ওর প্রাপ্য নম্বরের চেয়ে বেশী দিয়েছিলাম, যাতে ও উৎসাহ পায়। এবং তাতে কাজও হয়!
এক বছরের স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে জীবনের ঐ একটা বছর আমাকে একটা একদম নতুন অভিজ্ঞতা দিল। আমি যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে 100 জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে বসলে 90 জন-ই স্টার পায়। তারপর চাকুরী পেলাম সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে!কিন্তু সত্যি বলতে কী আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছিল আমার ঐ ছাত্রীরাই। যেটা ওদের দরকার ছিল, তা হল একটু ভালোবাসার, সঠিক guidance-এর। বকে-মেরে তো নয়-ই, ওদের মন জয় করতে পারলে, ওদের অসুবিধা টা feel করে ওদের বোঝালে, শেখালে ওরা ঠিক বুঝত বা শিখত। কিন্তু ক’জন সেভাবে ধৈর্য্য নিয়ে পড়াত ওদের? Corridor দিয়ে off period এ হাঁটলেই দেখতাম ক্লাসের বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ, ঘরের ভেতর প্রচণ্ড মূর্তিতে অঙ্কের দিদিমণি স্কেল হাতে মারতে উদ্যত কাউকে!স্টাফরুমে খাতা দেখতে বসে কোনো কোনো টীচার ছাত্রীকে বড় বড় শূন্য দিতে পারলে আর কিছু চান না!! অবশ্য সবাই এমন নয়। মেয়েরা বই কিনতে পারে না, স্টাফরুমে পাঠ্যবই, সহায়ক বই-এর ছড়াছড়ি। পাবলিশার্স-রা টীচারদের নামে সবরকম বই-এর copy পাঠায়। এছাড়া ‘সর্বশিক্ষা’র টাকায় বই কেনে স্কুল। আসার আগে আমার ভাগের বই সব ছাত্রীদের দিয়ে এলাম। এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে দোষারোপ করা নয়। একটি বাস্তব খণ্ড চিত্রমাত্র। তিরিশ বছর ধরে যারা ঐ স্কুলে পড়াচ্ছেন তাদের মুখে শুনেছি আগে আরো খারাপ অবস্থা ছিল স্কুলটার । এখন তো তাও 5-6 জন star পায় মাধ্যমিককে । আর উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগটিও গত কয়েক বছর খোলার পর ভালোই ফল করছে। সেটাই আশার কথা। ঐ স্কুলটা-তে যদি চাকুরী সূত্রে না পৌঁছতাম, তাহলে পত্র পত্রিকাতে এই সংত্রান্ত রিপোর্ট গুলো পড়ে ভাবতাম এরা বাড়িয়ে লেখে বা হয়তো বিশ্বাস করতাম কিন্তু অনেক খবরের মত ঐ খবর গুলোও ভুলে যেতাম! কিন্তু এখন আমি অনুভব করতে পারি। কত মানুষ কত কষ্ট করে জীবনে কিছু করার চেষ্টা করছে। ওরা যেদিন সবাই আর ‘দলছুট’ হবে না, ওরা যেদিন সবাই আমাদের মতো ভাগ্যবান দেশবাসী হয়ে উন্নয়ন নামক গাছের ফলটা তারিয়ে তারিয়ে খাবে, সেদিন সত্যিই বলব আমাদের দেশ উন্নত হয়েছে! আর কোনো দলছুট -এর যেন না থাকে সেদিন কোনো স্কুলের খাতায়…. ।।





লেখিকা : মৌমিতা চৌধুরী
১০ই জুলাই, ২০০৮
মুম্বই, ইন্ডিয়া।

19 comments:

Sharmila Dasgupta said...

meyeder ei obosthar kotah ami poRechhi, ekhon tor lekhay tar rooRo bastober chhoNwa pelam...

Anonymous said...

Ekta kothin Bastob chitro eNkechhish Mou.

Anonymous said...

Onekta chhobi age chhilo kintu khub poriskar holo tor bastob obhignyata pore. Darun ekta lekha porlam

Unknown said...

sikhka byabosthar je chobi tomar bastob obhiggotar ronge sundor bhabe rangiye tule sokoler samne niye esecho ta sotti e prosongsoniyo... tomar prochesta ke kurnish janai

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Kothor bastober rupdaan dekhlam ei probondhe; khub bhalo likhechhish Mou.

Shraddha.

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...
This comment has been removed by the author.
Unknown said...

মৌমিতা চমৎকার লিখেছিস। কঠিন বাস্তবের একটা পরিষ্কার ছবি পেলাম তোর লেখাতে....

Anonymous said...

ato sundor kore bastob chitro ta tule dhorecho chokher samne jeno chobir moto sob dekhte pacchi.khub bhalo laglo pore.

suparna b

Anonymous said...

mou..khub drirha ar satej hayechhe lekhata. ekta kathin bastab chitra, jeta niye aamra khub kam mathaa ghamai.oder mon ke bojhaar chesta aar koto ta kori?
tomar lekhar sange sange tomar proyaas o khub e bhalo laglo, khub e tripti pelam

Anonymous said...

ekta shokto jinis khub sundor kore bola hoyechhe... darun hoyechhe lekhata

Arunima said...

osadharon...khub sohoj vabe bastab ta tule dhorechis..

Priyanka said...

akta kothhor bastober sombondhe dharona'ta aro poriskar holo...

moumitachowdhury said...

amar lekha tomader bhalo legeche jene khushi holam. tobe eta amar moner kone jome thaka anekdiner kostho theke lekha...ekhono phire takale sei mukhgulo bhese othe . r ami oder jonne kichui korte parlam na, nijer khudro sukh tyag korar mohat khomota bhagoban amake deyeni, eta bhebeo majhe majhe besh oporadh-bodh jage...ami parini, hoyeto onyo keo sudhu oder katha bhabbei na, oder jonye kichu korbe...ei asha niye ghor kori!!

Soma Banerjee said...

ekta besh drirho sotyo ke tule dhorechho.... khub bhalo laglo...

jhum said...

mou vison jugopojogi lekha ar vison bolistho vabe tule dhorecho. bastob chitro tomar lekhar sabolilotai chokher samne dhora porche... khub valolaglo.

Unknown said...

moumita tomar lekhar modhye tumi anekgulo dik tule dhorechho.tomar lekha pore amio harie jachhilam amar purono studender kachhe.tumi oi schoole thakle amar mone hoi aj onek kriti chhatri k somaj peto.tomar feelings eto bhalo kore sajie likhechho ,sotti amake mugdho korechhe.

One World said...

bastob ke khub sundor kore tule dhorechhis.khub valo laglo tor lekha pore.

Asim said...

Priya Moumita,
Aajkaal sadharanata Galpa upanyaas pori naa kaaran segulo beshir bhag samay sei sangsaarer nana ati porichito ashanti, trikon prem, aboidha samparka niye lekha. Jaai hok sejanye ei BB blogey tomaar galpa porte deri holo. Kintu ek ni:shbaase pore chamke gelaam, jena mone holo aamaar nijer katha bolechho. Ei je samasyagulo ekhan Banglar chhoto boro sab schooley ekta birat samasya hoye dariyechhe taar dike je nijer baastab abhiggata diye bujhte cheyechho ebang nijer khudra chesta diye kichhu karar sarthak rup dite perechho seta pore aamaar chokhe jal ese gechhe. Aamaar nijer erakam kaaj karar ichhe. Aami gram banglar dur duranter medhabi gareenb chhele meyeder niye kichhu karar swapna dekhi, kintu beshidoor jete paari ni. Aamar aasheerbaad jeno. Aaro bhalo galpa lekha nijer jibaner bastab abhiggata diye.
Asim Jyethu

Shuchismita said...

etodine porlam. lekhata bhison bhalo hoyechhe re Mou. ei chhobi ta amar chena. ami nije ei rokom ekta school theke pass korechhi. taai aaro beshi anubhob korte parchhi. bhabisyate jodi abar kokhono sujog paas, school e poras. ei meyeder toder moto manusher sahajya chai i chai.