Saturday, August 9, 2008
এত টুকু বাসা :
মেদিনীপুর গামী লোকাল ট্রেনটা হাওড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। লেডিজ কামরায় জানালার ধারে একটি মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির গভীর চোখ দুটিতে বিষাদের ছায়া সুস্পষ্ট। মেয়েটির নাম বৈশালী।
ছোট বেলা থেকে অনেক ঝড় ঝাপ্টা ওর জীবন কে প্রতি মুহূর্তে চুরমার করে দিয়েছে। একদম ছোট্ট বেলায় তার বাবার মৃত্যু তাকে প্রায় অনাথ করে দিয়েছিল। তার মাও তার বাবার মৃত্যুর কিছু দিন বাদেই অন্য এক পুরূষের সঙ্গে কোন এক রাতে বৈশালী কে একা ফেলে রেখে কোথায় চলে যায়। সেই থেকে এই বিশাল পৃথিবীতে ছোট্ট বৈশালী্র একা একা সংঘর্ষের শুরু। অনাথ বৈশালী কে এরপর তার কাকা কোন রকমে একটু দয়া করে আশ্রয় দেন। নিছক এক আশ্রিতার মতো বৈশালী তার কাকা কাকিমার কাছে মানুষ হতে থাকে। বহু কষ্টে নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় সে বেশ ভালো ভাবেই স্কুলের গণ্ডি শেষ করে। কিন্তু তারপর তার কাকা কাকিমা কিছুতেই বৈশালীকে আর পড়তে দিতে চাইলেন না। অনেক মিনতী করে বৈশালী নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাবার প্রতিশ্রুতি দেবার পর কোন রকমে তাকে তাঁরা পড়াশনার অনুমতিটুকু দেন।
সারা দিন কলেজ করে সন্ধে বেলা চারটে টিউশন সেরে রাত ৯টায় বাড়ি ফিরে তার কাকিমার গঞ্জনা শুনতে শুনতে ঘরের সব কাজ শেষ করে বৈশালী রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এই রকম কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে সে কলেজের পড়াশোনাও শেষ করে ফেলে। সে চায় আরও পড়াশোনা করতে। কিন্তু এইবার আর তার কাকা কাকিমা তাকে দয়া করেন না। তাকে পত্রপাঠ জানিয়ে দেন যে তাঁরা আর তার ভার বহন করতে পারবেন না। বৈশালী কে এবারে নিজের জীবন নিজেই চালিয়ে নিতে হবে। হাজার অনুনয় বিনয়তেও তাঁরা আর কোন কর্ণপাত করেন না। সৃষ্টিকর্তা আরও একবার তাকে নিরাশ্রয় করে দিলেন।
বৈশালী বুঝতে পারেনা এই কঠিন পৃথিবীতে কোথায় সে এতটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে? কটা টিউশন করে তার যতসামান্য যা আয় হতো তাই দিয়ে তো কোথাও আশ্রয় পাওয়া সম্ভব নয়? কি করবে এখন সে? সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এই সময় বৈশালী কে সামান্য কৃপা করলেন। তার স্কুলের এক পুরানো বান্ধবীর বাড়িতে কিছুদিনের জন্যে একটু আশ্রয় তার জুটে গেল। এবার বৈশালী পাগলের মতো একটা চাকরির খোঁজে দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। অবশেষে একটি স্কুলে সামান্য মাইনের একটা চাকরি জোটাতে সক্ষম হয় সে। তারপর সেই বান্ধবীর বাড়িতেও আর তার ঠাঁই হয় না। সেখান থেকেও বিতাড়িত হতে হয় তাকে। বহু কষ্টে একটি লেডিজ হস্টেলে আশ্রয় নেয় সে। কিন্তু, ওই স্কুলের চাকরির সামান্য মাইনের চাকরিতে লেডিজ হস্টেলের খরচ চালান তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না কোন মতেই। তাই বৈশালী আরও একটু ভাল চাকরির চেষ্টা করতে থাকে।
এইরকমই কোন একদিন চাকরির খোঁজে ঘুরতে গিয়ে কুণালের সঙ্গে বৈশালীর পরিচয় ঘটেছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান কুণালও অনেক সংঘর্ষ করে জীবনযুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করাবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। বৈশালীর কুণাল কে দেখেই ভীষন ভাল লেগেছিল তাই দুজনের মধ্যে ভালবাসা গড়ে উঠতে বেশী সময় লাগেনি। পৃথিবীতে দুটি হৃদয় মিলিত হয়ে জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। দুটি সুন্দর মন অনেক রঙীন স্বপ্ন বোনে। তারা এক প্রাণ হয়ে একটি সুখের নীড় গড়তে চায়। বৈশালী বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় মোটামুটি একটি ভাল স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু কুণাল বহু চেষ্টা করেও কোন চাকরি পায় না। দিনের পর দিন ব্যর্থতা কুণাল কে অধৈর্য্য করে তোলে। কুণাল মানসিক ভাবে ভীষন ভেঙ্গে পড়ে। বৈশালী ক্রমাগত কুণালকে উৎসাহ প্রদান করে যায়।
একদিন সত্যি সত্যি অন্ধকার রাতের অবসান ঘটে ভোরের নতুন সূর্য্য দুটি জীবন কে আলোকিত করে তোলে। কুণাল একটি ভালো কোম্পানিতে চাকরি পায়। সেদিন কুণালের জীবনে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। খুশীর জোয়ারে ভাসতে ভাসতে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে বৈশালী কে খবরটা জানায় কুণাল। কুণাল বৈশালীকে বলে, “তুমি তৈরী থাকো আমি আসছি তোমার সাথে দেখা করতে”...
বৈশালী ভেবে পায় না সে আনন্দে কি করবে। জীবনে এই প্রথম সে সুখের আস্বাদ পেলো... সুখ কি জিনিষ তা অনুভব করল। তার মনে হল এতদিন জীবনে সে যত দুঃখ পেয়েছে সেই সবের যেন আজকে অবসান ঘটল। আজ নিজেকে তার পরিপূর্ণ মনে হতে লাগল। আজ তার প্রথম মনে হল আয়নায় নিজেকে নিরীক্ষণ করবার কথা। আয়নার সামনে বসে বৈশালী অনেক্ষন চেয়ে থাকল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। জীবনে কত দুঃখ সে পেয়েছে কিন্তু কখনও সে হার স্বীকার করেনি একভাবে লড়াই করে গেছে জীবনের প্রতিটি দুঃসময়ে। আজ আয়নায় নিজেকে বেশ সুন্দর মনে হচ্ছিল বৈশালীর। নিজেকে এই প্রথম বৈশালী খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুলল। তারপর অধীর আগ্রহে কুণালের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। আজ সময় যেন কাটতে চাইছেনা। বৈশালী বারে বারে ঘড়ি দেখে আর ছটফট করতে থাকে কখন কুণাল কে আজকে সে কাছে পাবে? কিন্তু সময় বয়ে যায়, কুণাল আসেনা। বৈশালী পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে কুণালের জন্যে। ভেবে পায় না সে কিভাবে কুণালের খবর নেবে কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করবে?
এই সময় হঠাৎ বৈশালীর মোবাইল ফোনটা সশব্দে বেজে ওঠে। বৈশালী চমকে ওঠে। কোন এক অজানা আতঙ্কে বৈশালীর মন কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে ফোনটা কানে দিয়ে “হ্যালো” বলে সে। ওপার থেকে কোন এক অজানা কন্ঠস্বর ভেসে আসে...হ্যালো আমি পিজি হাসপাতাল থেকে বলছি...কিছুক্ষন আগে এক ভদ্রলোকের বাস অ্যাক্সি্ডেন্টে মৃত্যু ঘটেছে। তার পকেটে মানিব্যাগের মধ্যে এই ফোন নম্বরটা পেয়ে আপনাকে খবর দিচ্ছি আপনি দয়া করে এখানে এসে লাশটা একটু শনাক্ত করে যান...
বৈশালীর কানে কোন আওয়াজ আর পৌঁছাচ্ছে না। তার কানের ভেতর মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য হর্ণের আওয়াজ হয়ে চলেছে। বৈশালী খালি দৌড়ে চলেছে যানে না কোথায়? হঠাৎ বৈশালী দেখল যে সে হাসপাতালের মর্গের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে আর তার সামনে কুণালের দোমড়ানো মোচড়ানো দেহটা পড়ে রয়েছে। বৈশালী পাথরের মত সেদিকে চেয়ে আছে। পৃথীবিটা আজ তার চোখের সামনে যেন ভীষন দুলছে। ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হাটতে লাগল সে। জানেনা কোথায় চলেছে সে। আজ সে বড় ক্লান্ত। আজ বৈশালী আবার নিরাশ্রিত।
কিছুদিন আগে ঝাড়গ্রামের একটি স্কুল থেকে চাকরির একটা প্রস্তাব পেয়েছিল বৈশালী। কিন্তু কুণাল কে ছেড়ে থাকতে পারবেনা বলে চাকরিটা তখন নেবেনা ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন আর বৈশালীর কোন পিছু টান নেই। তাই কোলকাতা শহরকে আজ চিরতরে বিদায় জানাতে চলেছে সে। শূণ্য বুকে বিষাদ কে স্মৃতি করে আজকে বৈশালী আবার চলেছে নতুন বাসার খোঁজে নতুন দিশার দিকে।
ট্রেনটা সশব্দে হর্ণ বাজিয়ে নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেনটা চোখের বাইরে চলে গেল...।
লেখিকা : শুচিস্মিতা (ঝুম) সেন
১২ই জুলাই, ২০০৮
দোহা, কাতার।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
23 comments:
khub bhalo laglo golpoTa...
Jhum , khubi onyarakom. tui khub bhalo likhis.
bhalo laglo tomar lekha
besh bhalo laglo lekha ta! jodio boddo dukkher golpo!
ঝুম খুব ভাল লাগল গল্পটা। সঙ্গে বিদুলার আঁকা।।
golpo ebong chobi dutoi khub bhalo legeche
Shottyi golpo ar ilustration ... dui-i khub bhalo.
khub bhalo golpo jhum.
jhum bhison bhalo laglo golpo ta
khub bhalo golpo....i think its 1 of the best story in the blog, but ofcourse its my personal opinion ;)....xpcting more stories like dis.
eto koster golpo likhechis keno! kintu tor lekhar bNadhon ta khub sundor,erpor hasir golpo likhis,please!
JJ, khub bhalo laglo golpo ta. Khub realistic.
bhaalo laaglo lekhata kintu khub mon kharap kora.....
khub sundar kore likhechhisre Jhum...porte poreye ek durbhaga bandhobir jibani mone pore gelo.....dukher holeo karo karo kopale mone hoi ebhabei sukher abhab thake
ei meye, eto dukhher golpo keno ? khub bhalo hoyechhe....
darun laglo
prio jhum
tomar golpo ta pore amar khub kosto hoechhe jano.eto bhalo ki kore likhle?
Bhishon bhalo likhecho...emni aaro shundor golper opekhaye royeelam!
ami tomader sokoler kache vison vabe kritoggo tomra sokole je amar lekha golpo dhoirjo niye porecho tar jonne. sokolke osonkhyo dhonnobad janai.
Jhum,
Tor galpata aagei porechhilam, kintu anek matamater pare mataamat dite bhule giyechhilaam. Itimadhyei tor galper prasangsa kore etajan sadasya nanarakam mantabya likhechhe je taate kare eti je besh bhalo hayechhe seta besh bojha jaay.
Tui galper pradhan charitratike sundar bhabe portray korechhis. Oke jeeban juddhe naamiye diye or pareekkha niyechhis. Seshkaale oke ekebaare Sukhi milanaantak galper mata sesh naa kare sahaser parichay diyechhis seta ekta balistha padakkhep. Aajkaal biyogaanta dukkher galpa khub ekta porte bhalo laage naa, tabe tor charitra chitrane aami sesh porjonto pore sesh korechhi. Toke jaanaai akuntha abhinandan.
Boishali ki jeeban juddhe haar maanlo naa niyatike mene nilo!
Jhum.. khub sundor likhechho. tomar moromi mon ti dhora porechhe golpo ti te.
aar sathe Bidula-dir chhobi ta boddo bhalo.
Khub Pranobonto lekha apnar.
jodio onek agei publish hoyechhilo but ami ajke porlam......jhum bhison bhalo laglo....kemon akta kosto mon take chunye galo....
Post a Comment