Thursday, August 7, 2008

পুজোর প্রাপ্তি :



সকাল থেকে একটানা ঝিরঝিরে বৃষ্টি সন্ধ্যের দিকে মুষল আকার নিলো। দাদা কাজ থামিয়ে বাইরের দিকে একবার তাকালো। আনমনা হয়ে বলল “কয়েক বছর ধরে এই শুরু হয়েছে, পুজোর আগে এই সময়ে সারাদিন ধরে বৃষ্টি!” দাদা একমনে চড়া ২টো বাল্বের আলোয় টুলের ওপর দাঁড়িয়ে মা দুর্গার চোখ আঁকতে ব্যস্ত। আমি তার পেছনে একটা ছোট্ট জলচৌকিতে বসে বসে তা দেখে চলেছি। আমার কাজ ই এই সময় হলো তার ফাই ফরমাশ খাটা। এই যেমন হয়তো কখনো বললো “ওই মোটা তুলিটা আমার হাতে দে তো” বা "ওই জরিটা বেশ হবে লাগালে, আনতো ধরে দেখি”। তার পরেই হয়ত চাইলো আঠা। কখনো কখনো দাদা যে এসব বিষয়ে আমারও পরামর্শ নেয় না, তা নয়। যদিও আমি ওর চেয়ে প্রায় ৯-১০ বছরের ছোট। কখনো বেশ উৎসাহী হয়ে বলি “এটার থেকে ওই জরিটা” বা “এই কাপড়টা দিয়ে মায়ের শাড়ী করো না, খাসা লাগবে”। এসব আবদারে দাদা মুচকি হেসে বলে “বাজেটটা তো দেখতে হবে”। ওর এসব কথার অর্থ আমি ঠিক বুঝিনা। তবে আমার সবচেয়ে মজা লাগে যখন ও আমায় বলে কাছের দোকান থেকে হুবহু কোনো চুমকি বা জরি এনে দিতে। আমি এক ছুট্টে সেখানে যাই, দোকানটা আমার বেশ পছন্দের। এত রকমারি চুমকির সম্ভার, সেসব থেকে আলো ঠিকরে পরে। আমি এক ধরনের জিনিস দেখতে গিয়ে দশ ধরনের জিনিস দেখে ফিরি। অবশ্য খুব কম সময়ই নিই দাদার ভয়ে। কখনো কখনো নতুন কিছু খুব ভালো লেগে গেলে দাদাকে নিয়ে এসে দেখাই। দাদাও বেশ খুশিই হয় মনে মনে। দাদা তিন চার বছর হলো দুর্গা ঠাকুর বানাচ্ছে, বাবা চলে যাবার পর। অবশ্য এর আগে ছোট খাটো প্রতিমা গড়ে হাত পাকিয়েছে আর ঠাকুরের দয়ায় সারা বছর তো একটা না একটা পুজো লেগেই রয়েছে। বাবা কাকার কাছে থেকে থেকে ও এই কাজ শিখেছে। প্রতিমা তৈরীতে ওর এ পাড়ায় বেশ নামডাক।

পুজো উপলক্ষ্যে আমার একটা নতুন শার্ট প্রাপ্তি হয়েছে। দেখতে দেখতে পঞ্চমী এসে গেল । দাদা যে প্রতিমা গুলো বানানোর ভার নিয়েছিলো, তাদের মধ্যে যেটা আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিলো, ক্লাবের লোকেরা সদলবলে নিয়ে গেল। আমি দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে দেখলাম। ভীষণ রাগ হচ্ছিল লোকগুলোর ওপর। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমার ছোট্ট হাতে এতবড় প্রতিমাকে আটকে রাখা কোনো রকমে সম্ভব না, কিন্তু দাদা ওই একই রকম নির্বিকার, যেমন নির্বিকার ছিলো সে এই প্রতিমা তৈরীর সময়। লোকগুলোর দাঁত বের করা হাসি দেখে মনে হলো বেশ পছন্দ হয়েছে দাদার কাজ। বাকি টাকা দিয়ে তারা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো। মা দুর্গার পর একে একে লক্ষ্মী, সরস্বতী সবাই ট্রাকে উঠল। চারপাশ সমবেত চিৎকারে ভরে গেল, -দুর্গা মা কি জয়!!

দ্রুত এলো ষষ্ঠী, এলো সপ্তমী। সেদিন বিকালে হঠাৎ দাদা আমায় আর রিনা-দুই ভাই বোনকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গেল। নতুন শার্ট পরে আমার সেদিন সে কি আনন্দ! আমার সেই প্রিয় প্রতিমার স্থান হয়েছে ‘সকলের ক্লাব’ এ। লাইটিং দেখে তো আমি থ। বরফের মতো স্বচ্ছ প্যান্ডেল, চারপাশ থেকে হাল্কা হাল্কা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। প্যান্ডেলে ঢোকার জন্য এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে লাইন ছাড়িয়ে চলে গেছে। একটু বাদে বাদে ২০-২৫ জন করে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে ।

বহু কষ্টে আমরা প্যান্ডেলে তো ঢুকলাম, চারিদিকে রকমারি আলো। তা বরফের স্ল্যাবে পরে মায়াবি পরিবেশ করে তুলেছে। চকমকে শাড়ী, পোশাকে সবাই ভীড় করেছে। দাদার হাত ধরে ভীড় ঠেলে কোনরকমে ঢুকছি। আমরা যে এই ঝাঁ চকচকে ভীড়ে বেশ বেমানান তা লোকেদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু সবশেষে মা দুর্গা ও তার পরিবারের লোকজনের দিকে তাকানোর পর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল এতক্ষণে আমরা আমাদের পরম আত্মীয়দের এই ভীড়ে খুঁজে পেয়েছি।



প্রিয়াঙ্কা সান্যাল
মিনেপলিস, আমেরিকা
২৫শে জুলাই, ২০০৮

7 comments:

Sharmila Dasgupta said...

opurbo bornona...khub bhalo laglo...

Anonymous said...

khub onyarakom. Chhoto , athocho sundorbhabe ekta chhobi phute uthechhe sundor ekta boktyaber songe

Unknown said...

khub bhalo laglo tomar lekha...

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Ekta kothor bastob shottyoke boro shundor bornona diyechhish.

Soma Banerjee said...

khub sundor dristibhongi te likhechho....

Kaushik said...

khub valo laglo...

Shuchismita said...

golpo ta bhison bhalo suru hoyechhilo. sahaj, sachchhando gori. nodir moto tor tor kore egiye jachchhilo. kintu boddo taratari sesh hoye gelo je! eto sundor lekhar style.. aaro porte mon chaichhe.