Friday, August 8, 2008

অজানা হাতছানি :




অনূসুয়া, পৌলমী ও রক্তিমা —প্রায় ১০ বছর পর আবার আজ মুখোমুখি, কলেজের শতবার্ষিকী মিলনমেলায় । এতগুলো বছর পরে একে ওপরকে দেখে উল্লসিত। হঠাৎই যেন তারা ফিরে যায় সেই ১০বছর আগের দিন গুলোতে। চোখের সামনে থেকে সরে যায় ১০ বছর, মন থেকে সরে যায় ১০ বছরের ব্যবধান। মনে পরে যায় সেই দিনের কথা যখন তারা সদ্য কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দেওয়া প্রানবন্ত তিন তরুণী। প্রত্যেকের চোখে রঙীন স্বপ্ন আর উজ্জ্বল ভবিষ্যত। কলেজে ঢুকেই এদের বন্ধুত্ব শুরু, কিন্তু কিছু দিনেই মধ্যেই ওরা হয়ে ওঠে হরিহর আত্মা। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে ক্যান্টিন সব জায়গাতেই একসাথে উপস্থিত এই তিন মূর্তি। পড়াশুনা, আড্ডা, সিনেমা দেখা, একসাথে শপিং করা এভাবেই আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে যেতে থাকে। নিজেদের সুখ দুঃখের কথা এরা বিনা সঙ্কোচে একে ওপরকে বলে। তবে এদের মধ্যে যে তর্ক বিতর্ক হতো না সেটাও ঠিক না। একটা ব্যাপার নিয়ে এদের মধ্যে সর্বদা তর্ক বিতর্ক লেগেই থাকত ,তা হল “love marriage” না “arrange marriage” কোনটা ঠিক? পৌলমী ও রক্তিমা’র মতে একজনকে না জেনে শুনে বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না আর অনূসুয়ার মতে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূ্র্ণ সিদ্ধান্ত মা-বাবার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। এই নিয়ে তর্ক শুরু হলে তার নিষ্পত্তি কোন দিনই হতো না। কেউ কারো মত থেকে এক চুলও সরতো না। এভাবেই ভালোবাসা ,বন্ধুত্ব তর্ক ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে এদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে।

হঠাৎই একদিন সকালে রক্তিমার ফোন অনূসুয়া ও পৌলমীকে “আজ একটু তাড়াতড়ি কলেজে আসবি জরুরী দরকার আছে”। অনূসুয়া ও পৌলমী তো ভীষন কৌতুহলী হয়ে সাত তাড়াতাড়ি কলেজ পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে রক্তিমাও এসে যায়। এসে সে জানায় আজ সে অবশেষে দেখা করতে যাচ্ছে তার সাথে। এই তিনি হলেন রক্তিমার “chat friend” ইন্দ্রজিত I.S.I এর এক কৃতি ছাত্র। প্রায় ১ বছর ধরে চ্যাট করার পর আজ অবশেষে দেখা করার সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে দুজনে। আজ বেশ সেজে এসেছে রক্তিমা,বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে ওকে। অনূসুয়া ও পৌলমী তো খুব খুশী, তারাই বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। কলেজ ছুটির পর রক্তিমা গেল দেখা করতে আর অনূসুয়া ও পৌলমী বাসে এই নিয়েই আলোচনা করতে থাকল। একজন বলে আজই ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে মনে হয়,আর একজন বলে ওঠে সেটা কখনই উচিৎ না আরও কছুদিন দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এভাবে যে যার বাড়ীতে পৌঁছে যায়। পরের দিন সকালে আবার তারা খুব উৎসাহে কলেজে আসে রক্তিমা এসে জানাই কাল বিকালটা বেশ ভালই কেটেছে,ইন্দ্রজিৎ বেশ ভালো ছেলে কিন্তু সে যেমন জীবনসঙ্গী চায় তেমন না,বন্ধু হিসাবে ঠিক আছে। অনূসুয়া ও পৌলমী ওর সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। আবার কিছুদিন পরেই সকালে রক্তিমার ফোন অনূসুয়া ও পৌলমীকে “একটা খুশীর খবর আছে তবে এখন বলব না সামনাসামনি বলব, অনূসুয়া ও পৌলমী বাসে যেতে যেতে ভাবে হয়ত ইন্দ্রজিৎ’কে নিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত রক্তিমা পাল্টেছে। কলেজে পৌঁছে দেখে রক্তিমা একা ক্লাসে বসে আছে। ওরা যেতেই রক্তিমা জানায় তার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে পাত্র Software Engineer পরের বছর U.K যাবে। ছেলেটির সাথে কথা বলে ওর ভালো লেগেছে ও বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে। অনূসুয়া ও পৌলমী তখন বিস্ময় কাটিয়ে বিয়েতে কী কী করবে তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করে দেয়। অবশেষে বিয়ের দিন এসে যায়, ওরা খুব আনন্দ করে।

কিছুদিন পর পৌলমী্ একদিন কলেজে আসে প্রচন্ড থমথমে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমোয়নি। রক্তিমা ও অনূসুয়া জিজ্ঞেস করতে থাকে কী হয়েছে? অনেকক্ষণ পরে সে জানায় তার বয়ফ্রেন্ড (প্রসুন) কাল চাকরী নিয়ে ম্যাঙ্গালোর চলে গেছে। রক্তিমা ও অনূসুয়া ওকে বোঝাতে থাকে যে কটা মাত্র দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ওরা পৌলমীকে বেশী করে সময় দিতে থাকে। এভাবেই কলেজের শেষদিন এসে যায়। প্রত্যেকের খুব মন খারাপ আর রোজ দেখা হবে না। তাও এটাই নিয়ম সবাইকেই মেনে নিতে হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ২ দিন পর আবার সবার দেখা এয়ারপোর্ট-এ, রক্তিমা চলে যাচ্ছে ওর বরের কাছে U.K। এখন অনূসুয়া ও পৌলমী রোজ দেখা করে গল্প করে ঘুরতে যায়। হঠাৎই এরমধ্যে পৌলমী এসে জানায় প্রসুনকে U.S.A যেতে হবে যাওয়ার আগে ওরা বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়। খুব তাড়াতাড়ি ওরা বিয়ে করে U.A.S’র উদ্দ্যেশে রওনা হয়ে যায়। অনুসূয়া ওদের তুলে এসে ভীষণ মনমরা হয়ে পড়ে,সে যে আজ ভীষণ একা হয়ে গেল।

এরপর অনুসূয়ার বাড়ী থেকে বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হয়ে যায়, কিন্তু তার কাউকেই পছন্দ হয় না, হবেই বা কী করে তার মন যে অন্য খানে বাধা। কিন্তু সে নাম জানে না তার, জানে না সে থাকে কোথায় । তাকে সে দেখোওনি কোনদিন, দেখেছে শুধু স্বপ্নে। যে স্বপ্নটা আজ মাস ছয়েক ধরে তাকে ঘুমোতে দেয়নি। স্বপ্নের কথা সে জানাতে পারেনি কাউকে এমনকি তার বন্ধুদেরও না। তবে সে এই ছয় মাসে সে ছেলেটির সাথে অনেক জায়গায় বেড়াতে গেছে, অনেক সুখ দুঃখের কথা বলেছে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে তাকে, সে স্বপ্নই হোক তাতে কী যায় আসে। তারপক্ষে অন্য কোন ছেলেকে মেনে নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু বাড়ীর সবাইকে বোঝানো সম্ভব না আর সে বোঝাবেই বা কী? তাই সে কোনো ছেলেকেই পছন্দ হচ্ছে না এই অজুহাত দিতে থাকে। বাড়ীর সবাই খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে তার ওপর। তারা পাত্র দেখাও ছেড়ে যায়। কিন্তু তারা লক্ষ্য করতে থাকে অনুসূয়া দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। তাকে জোর করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় শারীরিক কিছুই অসুবিধা ধরা পরে না, তবে ডাক্তার অনুসূয়া’র সাথে কথা বলে বোঝে অসুস্থতাটা শারীরিক না মানসিক। তাই তিনি অনুসূয়া’র মা-বাবাকে পরামর্শ দেন কোনো মনবিদ এর পরামর্শ নিতে। অনুসূয়া’র বাবা মা এতে কোনো আমল না দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। তবে যতদিন যায় অনুসূয়া’র শরীর ততই খারাপ হতে থাকে তখন নিরূপায় হয়ে তারা মনবিদ এর শরণাপন্ন হন। তিনি অনুসূয়া’র সাথে কথা বলে আসল ব্যাপার জানতে পারে। তিনি অনুসূয়া’র বাবা মাকেও জানায় পুরো ঘটনাটা। তারা সবাই মিলে অনুকে বোঝাতে থাকে, বেশ কিছুদিন পরেও অবস্থা একই থাকে। শেষে তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।mদীর্ঘ ২ বছর চিকিসা হওয়ার পর সে অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়ী ফেরে। তবে সে ঠিক করে যে বিয়ে করবে না। একটা স্কুলেও চাকরী পেয়ে যায়। এভাবেই তার দিন কাটতে থাকে। হঠাৎই একদিন খবরের কাগজে দেখে তাদের কলেজে শতবার্ষিকী মিলনমেলা হচ্ছে। আর সেখানে গিয়েই আজ এতবছর পর দেখা হলো তিন বন্ধুর।

সবাই যে যার জীবনের গল্প করতে থাকে। রক্তিমা ও পৌলমী তাদের সংসার, বর, সন্তান তার পড়াশুনা, শ্বশুড়বাড়ীর সুবিধা-অসুবিধা এইসব নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এখানে অনুসূয়া নীরব শ্রোতা, তার বলার কিছু নেই। সে তার স্কুলের কথা বলে। এভাবেই প্রায় কেটে যায় ৬ ঘন্টা। এবার বাড়ী ফেরার পালা। অনুসূয়া বাসে আস্তে আস্তে ভাবে তারও একটা সংসার হতো, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করতে পারত। তার বাবা-মাকেও একটু শান্তি দিতে পারত, তার জন্য ভেবে ভেবে বাবা-মা যেন বয়সের আগেই বেশী বুড়িয়ে গেছে। সে বাসে বসেই সিদ্ধান্ত নেয় এবার সে তার স্বপ্নের পুরুষকে ভুলে অন্য একজনকে সেই স্থান দেবে। আজ এই কথা শুনলে তার বাবা-মা কতোই না খুশি হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে সে বাস থেকে নেমে বাড়ীর দিকে হাটতে থাকে। সামনের একটা গাড়ী থেকে নেমে একটি ছেলে অনুসূয়ার উল্টোদিক থেকে আসার সময় অনুসূয়ার অন্যমনস্কতার জন্য ছেলেটি তার সাথে ধাক্কা খায়। অনুসূয়া ফিরে ছেলেটিকে দুঃখিত বলতে গিয়ে চমকে ওঠে, মনে মনে বলে ওঠে “আরে এই তো আমার স্বপ্নে দেখা পুরুষ”। ছেলেটিও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অনুর দিকে। তাহলে কি ছেলেটিও এতদিন তার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। অনুসূয়া দেখে তার সামনে ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে কিছু না ভেবেই অজান্তেই বাড়িয়ে দেয় তার হাতখানি তার স্বপ্নের পুরুষের দিকে।





লেখিকা : অর্পিতা পান্ডা(রায়)
১২ই জুলাই, ২০০৮
ব্যাঙ্গালোর, ইন্ডিয়া।

20 comments:

Sharmila Dasgupta said...

shundor lekha...

Anonymous said...

bhalo laglo re.

Unknown said...

tomar golpota porte porte bhabchilam ses mes anasuyar ki holo.. seser chomok tai daarun... khubsundor likhecho

Anonymous said...

Arpita...khub sundor lekha ta laglo...

Pallabi

Satarupa said...

khub sundor hoyeche lekha ta....

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Aro Golpo ta golpo holeo shottyi..

Anonymous said...

bhalo. kichhuta hayto melodramatic, kintu ekta bastab o jeno lukiye aachhe lekhay. sab miliye sundar

Anonymous said...

bhari sweet golpo ta.

Bhaswati said...

bhalo!

Bhaswati said...

bhalo!

Sonali said...

Khub sundor hoyeche lekhata

Soma Banerjee said...

misti premer golpo....

jhum said...

arpita vari valolaglo pore golpota. khub sundor...

Anonymous said...

choritrogulo chena chena khub....bhalo likhechish.

Anonymous said...

KHUB MISTI EKTA GALPO

Shuchismita said...

khub mishti ekta golpo!

Anonymous said...

aktuo valo lglo na...khub bj..khub obastobik..

Unknown said...

nah sesta valo holo na golpo ta aro boro hote parto

Unknown said...

Prem ta jomlo na thik.bt its ok

Unknown said...

Prem ta jomlo na thik.bt its ok