Sunday, August 10, 2008

ত্রিনয়ন :




বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজ মেলাবার আগেই এক দঙ্গল ছোট ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো গঙ্গায়। তাদের বয়স সাত থেকে পনেরো। মায়ের গয়না, অস্ত্র, কাঠামো, যে যা পারছে উদ্ধার করছে। স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে তারা কাড়াকাড়ির উল্লাসে মেতে উঠেছে। এর বিনিময় কিছু টাকা রোজগার করা যায় প্রতি বছর।

ভোলা এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। এই তার রোজগারের প্রথম প্রচেষ্টা। অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে কিছুই যোগার করতে পারলো না সে। ক্লান্ত ভোলা হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ডাঙ্গার কাছে পৌঁছে গেছে, ছোট্ট একটা মাটির ঢেলা হাতে এসে ঠেকলো। ভোলা তুলে নিয়ে দেখে মা দুর্গার ভাঙ্গা মুখ। একটা কান নেই, দু ছড়া চুল কোনোরকমে আটকে আছে, নাক চটে গেছে, একটা চোখ ধুয়ে বিবর্ণ। কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে দেখে, ত্রিনয়নীর তৃতীয় নয়ণ সজীব হয়ে জ্বলজ্বল করছে, যেন এইমাত্র তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে। ভোলা মুখখানা গামছায় বেঁধে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

আজকাল তার বাড়িতে থাকতে একদম ভাল লাগে না। রোজ রাতে বাবা মাতাল হয়ে মাকে অশ্রাব্য গালাগাল দেয়, মারধরও করে। মায়ের যন্ত্রনাকাতর চোখদুটো আর ছোট ছোট তিনটে ভাইবোনের ভয়ার্ত কান্না তাকে তাড়া করে ফেরে। পয়সার অভাবই যে সব কিছুর মূলে, ছোট্ট ভোলা তা বুঝে গেছে। তাই সে ঠিক করেছে কিছু রোজগার তাকে করতেই হবে। মায়ের স্বপ্ন ভোলা লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হলে তাদের দুঃখের দিনের অবসান ঘটবে।

সে রাতেও বাবার রণচন্ডি মূর্তি দেখে আর জড়ানো গলায় গালাগাল শুনে ভাইবোনেরা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বাবা টলতে টলতে এসে সজোরে তাদের গালে ঠাস ঠাস করে থাপ্পর মেরে মায়ের চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিলেন। সব মায়ের দোষ - বেকারত্ত্ব, এতগুলো অকালকুষ্মান্ড জন্ম দেওয়া, দুবেলা ঠিকমত খেতে না পাওয়া, সব সব।

ভোলা কানে আঙ্গুল দিয়ে ঘরের কোনায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সন্তর্পনে গামছা খুলে মায়ের মুখখানা চোখের সামনে এনে ফিসফিস করে বলল, তোমার তো তিনটে চোখ, কিছুই দেখতে পাও না?

হঠাৎ মায়ের ত্রিনয়ন থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে চারিদিক আলোকিত করে তুললো। যেন হাজার ঢাকে কাঠি পড়লো। শঙ্খ আর উলুদ্ধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিতো। পুরুত মশাইয়ের ধুঁনুচির ধোয়ায় সামনেটা আচ্ছন্ন।

ধীরে ধীরে ধোঁয়ার পর্দা সরে গেল। নজরে এল টলটলে একটা দীঘি, নারকেল গাছের সারি। ধবল গাইরা কৃষ্ণচূড়া গাছে তলায় বসে নিশ্চিন্তে জাবর কাটছে। দীঘির ধারে ওরা কারা বসে? হ্যাঁ, ঐ তো তার মা বাবা! বাবার পরনে পরিষ্কার হাফ হাতা শার্ট আর পাজামা। মায়ের চুলে বাহারি খোঁপা, গায়ে ডুরে শাড়ী। ভালবাসার প্রতীক যেন তারা। হাতে হাত রেখে মা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে নতমুখে বসে আছেন আর বাবা সজত্নে তাঁর কপালে উড়ে আসা চুল সরিয়ে দিচ্ছেন।বাবা মাকে এত ভালবাসেন? তাহলে এখন কেন এমন বদলে গেছেন? অভাব? ব্যর্থতা? অক্ষমতা? তাই হবে!

ঐ তো! মাঠে ওরা চার ভাইবোন খেলা করছে। সকলের গায়ে ফর্সা ছিটের জামা, মুখে তৃপ্তির হাসি। রঙ্গিন প্রজাপতির মত ছুটে বেড়াচ্ছে। খেলতে খেলতে ছুটকি পড়ে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। মা বাবা ছুটে এলেন ওদের কাছে। বাবা ছুটকিকে কোলে তুলে একটা হামি দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। ওমনি ছুটকি চুপ। বাবার গলা জড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

চার ভাইবোন মা বাবার হাত ধরে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরলো। তারপর মা যত্ন করে কত কি রাঁধলেন! ডাল, শুক্ত, মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস। এত সব খাবার একসাথে কখনই খায়নি তারা। মায়ের হাতের রান্নার কি স্বাদ! সকলকে বেড়ে ছুটকিকে খাওয়াতে বসলেন মা। ভোলা তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতে দেখলো বাবা মায়ের দিকে চেয়ে হাসছেন আর বলছেন, অনেক পুণ্যি করে তোমায় পেয়েছি। মায়ের মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।

খাওয়া দাওয়া সেরে ভাইবোনেরা মা বাবার মাঝখানে শুয়ে পড়লো। কত গল্প শোনালেন ওঁরা। রাজা রানির গল্প, রাক্ষসের গল্প, পরিদের গল্প। শুনতে শুনতে কখন যে চোখ দুটো ঘুমে ভারি হয়ে এসেছে টেরই পায়নি ভোলা।

ঝনঝন করে বাসন ছোঁড়ার আওয়াজ আর মায়ের ‘উফ!মা গো!’ বলে রক্তাক্ত কপাল চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না ভোলার কানে পৌঁছালো না।

সে এখন মা দুর্গার তৃতীয় নয়নের আলোকপথ ধরে দূর রাজ্যে পৌঁছে গেছে, যেখানে সে ভালবাসার আলো গায়ে মেখে, ফুসফুস ভরে বিশ্বাসের বাতাস টেনে সুখের ঘাস-গালিচায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ভোলার আলগা হয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয় মায়ের ভাঙ্গা মুখে, ত্রিনয়নের উপর টলটল করছে ওর চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া এক বিন্দু জল।




লেখিকা : শর্মিলা দাশগুপ্ত
১১ই জুলাই ২০০৮
দিল্লী, ইন্ডিয়া।

19 comments:

Linas said...

Mon kere nilo, Sharmila. Dukkhe'r sathi shukh. Aar sukher sathi dukkho.
Tomar golpe tari ekta drishyo dekhte pelam.

Anonymous said...

Darun laglo Sharmiladi. Monta ektu bhari holo bote kintu tar majheo jeno ki ekta ashar alo pelam... kothao keu achhe sokol dukhya-nashini.

Unknown said...

darun lekha sharmiladi.. obhaber songi dukhkho r sopnatur bholara banglar ghore ghore opekhhka kore thake ek mutho sukher...

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Oshombhob bhalo likhechho didibhai. Golpota porlei bojha jae tomar kolomer jor.

shraddha

Unknown said...

Darun bhalo laglo...akdom onno rokom...monta ektu bhari holo thik e...tobu o...

Anonymous said...

khub bhalo laglo golpo ta pore.

Anonymous said...

didi khub bhalo laglo golpo ta... monta chhuye galo..

Bhaswati said...

Sharmiladi tomar golpota boddo mone ke chNue geche.............ek kothae OSADHARON

Sharmila Dasgupta said...

golpoTa dhoirjo dhore poRa ebong bhalo lagar jonyo shokolke amar antorik dhonyobaad...

Manisikha said...

tomar lekhata pore gaye kanta diye uthlo....eto sundor bhabe bholar dukhkho kosto jontrona tarpor ekta sundor sopno...futiye tulechho....opurbo

Manisikha said...

tomar lekhata pore gaye kanta diye uthlo....eto sundor bhabe bholar dukhkho kosto jontrona tarpor ekta sundor sopno...futiye tulechho....opurbo

Anonymous said...

tomar lekhata pore gaye kanta diye uthlo....eto sundor bhabe bholar dukhkho kosto jontrona tarpor ekta sundor sopno...futiye tulechho....opurbo

Anonymous said...

tomar lekhata pore gaye kanta diye uthlo....eto sundor bhabe bholar dukhkho kosto jontrona tarpor ekta sundor sopno...futiye tulechho....opurbo

Arunima said...

khub sundor lekha Sharmiladi..khub valo laglo pore...

Soma Banerjee said...

bhishon bhalo r sundor laglo.... kintu sathe monta bhari o holo...

Unknown said...

eto bhalo likhechho ,pore bhiason kanna pachhe.bholar mukh chokher samne bhaschhe.sotti amra chhoto chhoto karone dookho pai r jara khub gorib ,dubela pet bhore khete pai na ,tader janya MA ki barta anen?

Asim said...

Priya Sharmila,
Aajkaal Delhi giye aar scrap koro naa. Jodio FCB te nana threadey mat binimay hoi. Okhane tomaar chhabita ekhaner theke anyarakamer dekhay.
Ebaare tomaar lekha prasange aasi. Asadharan ekta aabeg aar anubhooti mishiyechha ei galper madhye diye. Parisare chhoto holeo bhisan mon chhuye gechhe tomaar galpati. Tomaar galper naayaker haate Durgar Trinayan darshan jodi sabaar ghatto!

Shuchismita said...

sundor, ashabadi ekta golpo. baah!

Sharmila Dasgupta said...

shokolke arekbar dhonyobaad...